পুজোর সময়, নবমী সম্ভবত। AAEI ক্লাবে দুপুরে খেতে গেছি। কেনিয়ায় তখন ক্যাঙ্গারুদের সামনে অসহায় ভারত। সচিন, সৌরভ, দ্রাবিড় আউট, ক্রিজে নিজের ছায়ার মতো ফর্মে বিনোদ কাম্বলি।
১৮ বছরের বাঁহাতি ছেলেটা দৌড়ে গেল মাঠের মাঝখানে। ফর্সা, লম্বা, বড্ড ছটফটে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ব্যাট হাতে প্রথমবার। উল্টো দিকে গ্লেন ম্যাকগ্রা। একটা নির্ভুল বাউন্সার, পড়ার পরে টক করে একটা শব্দ। ফিদা হুসেনের তুলিতে আঁকা রাজকীয় হুক শটটা আছড়ে পড়ল স্কোয়ার লেগ বাউন্ডারিতে! বিরাশি সিক্কার থাপ্পড়।
একবার তাকিয়ে দেখল ম্যাকগ্রা। কে রে ছেলেটা?
চুইংগাম চিবোতে চিবোতে আবার গার্ড নিচ্ছে।
নীল জার্সির পিছনে লেখা নাম, যুবরাজ সিং!
শকাব্দ, খ্রীষ্টাব্দ, বঙ্গাব্দ যেভাবে শুরু, ওই দিনটাও সেরকম ছিল। নতুন যুগের শুরু। প্রথম ম্যাচেই ৮৪ রান শুধু একটা সংখ্যা ছিল না, আগমনী ছিল। ভারতীয় ক্রিকেটের নবজন্মের মহালয়া। মাথায় মহারাজ, আর অকুতোভয় যুবরাজ। পাঞ্জাব দা পুত্তর, অনেক না পাওয়ার উত্তর।
তারপর ন্যাটওয়েস্ট ফাইনাল। সঙ্গী কাইফ। ছক্কাগুলো এমন যে, আম্পায়ার ছয়ের বদলে বারো দিলে সুবিচার হতে পারত। আউট হয়ে ফেরার সময় মুখটা মনে পড়ে এখনও। অজয় জাদেজা বা কাম্বলির মধ্যে এমনিতে ওরকম আবেগ দেখতাম না। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে হোম টিমের বিরুদ্ধে অক্লেশে ১৩৯ করার লোকও আর কে ছিল।
২০০৭ কুড়ি বিশের বিশ্বকাপ। স্টুয়ার্ট ব্রড সেদিন স্টুয়ার্ট লিটল হয়ে গেছে।
ওভার শেষের স্কোরবোর্ড... যুবরাজ: ৬ ৬ ৬ ৬ ৬ ৬!
ওই টুর্ণামেন্টেই অজিদের বিরুদ্ধে ৩০ বলে ৭০। মাথায় রাখা ভালো, তখনও আইপিএল দিনের আলো দেখেনি।
কাপ আমাদের, সেরা প্লেয়ার যুবরাজ।
২০১১ বিশ্বকাপ। সফরের মাঝপথেই রক্তবমি, শরীর খারাপ। তা নিয়েই পরের পর উইকেট, প্রতি ম্যাচে রান! বিরাটচিত হুঙ্কার তখনও আমরা দেখিনি। আমরা যুবরাজকে দেখতাম। সৌরভের পর, আ ট্রু স্পোর্টসম্যান ক্যারেক্টার। জানা নেই, সুনীল দত্তের মতো যোগরাজ সিংও কি তখন ছেলেকে গান গেয়ে শোনাতেন? রুক জানা নহি, তু কহি হারকে...
মনে করিয়ে দেয়া ভালো, এবারও কাপ আমাদের, সেরা প্লেয়ার যুবরাজ।
এমন ফর্মের তুঙ্গে থাকার সময় ক্যান্সার! জীবনমৃত্যুর হিসাব ঝুলছে সরু সুতোয়। কেউ ভাবেইনি, বাঁচবে। ছেলেটা কিন্তু ক্রিকেটে ফিরতে চেয়েছিল। কেমো নেয়া ফোলা ফোলা শরীর, মাথায় একটা চুল নেই, সেই ছেলেটা যখন আইপিএলে পুনে ওয়ারিয়ার্স ক্যাম্পে ঢুকে ব্যাট নেড়েচেড়ে দেখছে, সত্যি বলছি, মনে হয়েছিল মৃত্যু খুব তুচ্ছ এর কাছে। এ ফিরবে। তথাকথিত মহান ক্যাপ্টেনের পছন্দের না হলেও ফিরবে।
ফিরেছিল। পরিচিত খুনে মেজাজে। সেই অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে। প্রথম রানটা নেয়ার পর চোখের কোলে জল শুধু ওর আসেনি। এতগুলো কেমো, ওষুধ তো শুধু নয়, লড়াইটা আরও বড় ছিল। নিজের ছায়া নয়, স্বমূর্তিতেই ফিরতে হবে, এটাই ছিল টার্গেট।
তবে এটা ভাবেননি, তিনিও টার্গেট ছিলেন। কিছু চার আনার ক্রীড়া সাংবাদিকের টার্গেট, কিছু আট আনার সতীর্থ ও কর্মকর্তার টার্গেট। তাই ম্যাচ হারলেই মুজরিম আপনি। লারজার দ্যান লাইফ আপনি, তাহলে অন্য কাউকে ভগবান বানানো হবে কি করে? তার ওপর আপনার শাস্ত্রজ্ঞান (শাস্ত্রী-জ্ঞান) কম। তাই বাদ।
রায়াডু ইন, কেদার ইন, দেদার ইন, এমনকী স্টুয়ার্ট বিনিও, আরও কারা কারা যেন দেশের জার্সিটা গায়ে গলানোর সুযোগ পেয়েছে, কিন্তু যুবরাজ? নাহ, ও আউট।
সেই কিন্তু ফেরাতে হল। প্রত্যাবর্তনে ১৫০ রানের ধুঁয়াধার ইনিংসটা হজম করতে হল। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ইনিংসটা লোকে হাঁ করে দেখল।
ট্রফিটা জিতে গেলে হয়তো অন্যরকম হতো, কিন্তু ফাইনালে হেরে যাওয়ার পর আপনি আবার সফট টার্গেট। প্রতি প্রতিবেদনে লেখা হতে থাকল, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ৮ রানে আপনার ক্যাচ মিস করেছিল বলেই ৫২ রানটা এসেছিল। যেন আর কোনও প্লেয়ারের ক্যাচ মিস হয়নি বা তার পরেও রান করলে তাকে নিয়ে ঘিনঘিনে আদিখ্যেতা হয়নি।
তারপরও দু বছর কেটে গেছে যুবরাজ। ২০১৯ এখন। আপনি আর দেশের হয়ে খেলেননি। তাই আজ হঠাৎ অবসরের ঘোষণাটা শোনার পর থেকে, কেমন যেন মুক্ত পুরুষ মনে হচ্ছে নিজেকেও।
আপনি দেশকে দুটো বিশ্বকাপ দিয়েছেন।
আপনি নিজের জন্য খেলেননি কোনওদিন।
আপনাকে ফর্মে ফেরানোর জন্য দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে সিরিজের পর সিরিজ খয়রাতি করা হয়নি।
আপনার জন্য কোনও কর্পোরেট লবিকে নামতে হয়নি।
আপনি জীবন দিয়ে ক্রিকেট খেলেছেন যুবরাজ। ক্রিকেট দিয়ে জীবন চিনিয়েছেন। খাদের ধার থেকে ফিরতে শিখিয়েছেন। মধ্যমেধার প্রবল চাটুকারিতার স্রোতে ভেসে যেতে রুখেছেন কত মানুষকে। জিততে শিখিয়েছেন।
বলতেই পারেন, আর ক্রিকেট খেলব না।
কিন্তু আপনি তো জীবনের মাঠে খেলছেন। অনন্ত অক্সিজেন ফুসফুসে নিয়ে।
অবসর নিলাম বলতে নেই যে... ❤️❤️❤️


No comments:
Post a Comment